সেই হারানো শৈশব, স্বপ্নিল কিশোরবেলা, মা হারা কিশোর তো সেই হারানো স্বপ্ন খুঁজতেই শৈশবে ফিরে যাই বার বার। ও চাঁদমুখী মা, তুমি শুধু একবার ফিরে এসো; এই অলঙ্ঘ্য বিষাদ সরিয়ে দু’হাতে আজ একটুখানি জ্যোৎস্না মেখে দাও। মা হারা এমনি শৈশবে মাতৃত্বের কোমল পরশের অভাববোধ যাদের জীবন জুড়ে তারা তো মাতৃত্বের স্নেহ মাখা আঁচল তলে শুভ্রতার ছায়া খুঁজবেই। ঠিক এমনি এতিমদের পূনর্বাসন, সুরক্ষা, মাতৃত্বের স্নিগ্ধ পরশ, সর্বোপরি আলোকিত মানুষ হিসেবে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিশিষ্ট শিল্পপতি, সমাজ সেবক মরহুম শেখ আকিজ উদ্দিনের অনুপ্রেরণায় এবং খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ মরহুম অধ্যাপক শরীফ হোসেনের উদ্যোগে ১৯৮০ সালে আদ্-দ্বীন নামক সোনার তরী তার শুভ যাত্রা শুরু করে। যাত্রার শুরুতে ক্ষুদ্রঋণকে প্রাধান্য না দিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে জনকল্যাণমূলক কাজের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। দীর্ঘদিন সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনার পর ১৯৮৯ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ১৯৯০ সালে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ ও এনজিও বিষয়ক ব্যুরো, ১৯৯৪ সালে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এবং ২০০৮ সালে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি (এমআরএ) এর উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে আদ্-দ্বীন অতিদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং আয়বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমে সমাজের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক পর্যায়ের মহিলাদের সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে ইসলামী শরীয়াহ্ মোতাবেক পরিচালিত “কমিউনিটি হেলথ্ এ্যান্ড মাইক্রোফাইনান্স” কর্মসূচির আওতায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কর্মসূচিকে সার্বজনীনভাবে মানুষের দ্বার প্রান্তে পৌছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। বর্তমানে আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার সেন্টার “কমিউনিটি হেলথ্ এ্যান্ড মাইক্রোফাইনান্স” কার্যক্রমের অধীনস্ত ১৪৫ টি শাখা অফিসের মাধ্যমে ১৮০০ জন দক্ষ জনবলের সমন্বয়ে ১৪ টি জেলার ৩ লক্ষাধিক প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
আদ্-দ্বীন বিশ্বাস করে উন্নয়ন কোন গন্তব্য নয় বরং একটি অগ্রযাত্রা মাত্র। আদ্-দ্বীনের লক্ষ্য, প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধশালী করার সাথে সাথে টেকসই উন্নয়নের ধারা চলমান রাখতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আর্থ-সামাজিক ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আদ্-দ্বীন তার জন্মলগ্ন থেকে বিভিন্ন প্রকার সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সর্বজন স্বীকৃত মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এতিম শিশুদের পূণর্বাসন, বিনামূল্যে চোখের ছানি অপারেশন, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, অসহায় ব্যক্তিদের মাঝে খাদ্য সহায়তা প্রদান, সমাজের পিছিয়ে পড়া সুবিধাবঞ্চিত ও আশ্রয়হীন ব্যক্তিদের মাঝে বিনামূল্যে আবাসন সুবিধা প্রদান, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকল্পে আদ্-দ্বীনের সদস্যদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা প্রণয়ন, আদ্-দ্বীনের কর্মএলাকার গর্ভবতী মায়েদের নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে “কমিউনিটি এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস” ২৪ ঘন্টার জন্য প্রস্তুত রাখা, দুঃস্থ ও প্রান্তিক পর্যায়ের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনাসহ নানাবিধ সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে আদ্-দ্বীন তার জম্মলগ্ন থেকে নিজস্ব অর্থায়নে কাজ করে আসছে।
এ দেশের সিংহভাগ মানুষ ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকে এখনও বঞ্চিত। বিশেষ করে অসচেতনতা, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, ব্যয়বহুল স্বাস্থ্যসেবা, সহজে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জটিলতা এবং অনুকূল পরিবেশের অভাব এদেশের মানুষের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অন্যতম কারণ। এই প্রেক্ষাপটে সবার সাধ্যের মধ্যে মানসম্মত, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন কর্তৃক ঢাকা, খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৪ হসপিটাল। স্বল্প ব্যয়ে দক্ষ চিকিৎসক তৈরির লক্ষ্যে যশোর, ঢাকা, কেরানীগঞ্জ ও খুলনায় গড়ে তোলা হয়েছে ৪ টি মেডিকেল কলেজ হসপিটাল। স্বল্প খরচে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা প্রদানের পাশাপাশি ন্যূনতম ব্যয়ে রেজিস্টার্ড নার্স, মিডওয়াইফ, মেডিকেল টেকনোলোজিষ্ট তৈরির লক্ষ্যে ৩ টি নার্সিং ইনস্টিটিউট, ১ টি মিড-ওয়াইফারী ইনস্টিটিউট, ১ টি মহিলা মেডিকেল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, ১টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিঃ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
যশোরে ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আদ্-দ্বীন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১০০-১২০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা, ধাত্রীবিদ্যা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, জেন্ডার ইস্যু, অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজ এবং আয়বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ১৯৯৭ সালে যশোর বিসিক শিল্প নগরী এলাকায় আদ্-দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যালস্-এর কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে আদ্-দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিমিটেডের ৪৩টি ঔষধ দেশের ৩১টি জেলায় বাজারজাত হচ্ছে। সংস্থাটির ১ টি অফসেট প্রিন্টিং প্রেস এবং ১টি হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। উক্ত কেন্দ্রের মাধ্যমে “কমিউনিটি হেলথ্ এ্যান্ড মাইক্রোফাইনান্স” কর্মসূচির আওতায় সমিতিভুক্ত নারী সদস্যদের উৎপাদনমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করানোর মাধ্যমে নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি করা এ কার্যক্রমের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কর্মএলাকার অসহায়, দরিদ্র, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা নারীদেরকে দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের নকশী কাঁথা, বিছানা চাঁদর, শাড়ি, থ্রি-পিচ, পাঞ্জাবী, ফতুয়া ও মেয়েদের হাত ব্যাগ ইত্যাদি সামগ্রী তৈরি করে। তৈরিকৃত সকল পণ্য ঢাকা আদ্-দ্বীন হাসপাতাল সংলগ্ন “উপমা” শো-রুমে বিক্রয় করা হয়।